পিরামিড রহস্য

পিরামিড! প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত মহাকীর্তির এক সপ্তম আশ্চর্যের রহস্যময় নির্দশন। যা এক বিরাট অবৈজ্ঞানিক স্থাপত্য শিল্প। এমন সব নির্মাণশৈলী মিসরবাসীর জন্য একমাত্র দুর্লভ প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রাজধানী কায়রোর অদূরে গিযা নামক স্থানে। বিস্ময়কর পিরামিডের জন্য সারা বিশ্বেই মিসরের সুখ্যাতি আছে, যা দেখার জন্য প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক আসে।
পিরামিডের মূল নির্মাতা মনে করা হয় মিসরের ফারাও রাজবংশকে। ধারণা করা হয়, জোসার শাসনামলে সর্বপ্রথম পিরামিডের নির্মাণকাজ শুরু হয়। পিরামিড নির্মাণে নিযুক্ত করা হয়েছিল বিপুল সংখ্যক দাস-দাসী। গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডেটাসের মতে, প্রায় এক লাখ লোকের দীর্ঘ বিশ বছরের পরিশ্রমে নির্মিত হয়েছিল পিরামিড। তবে পোলিশ স্থপতি ওয়েসলো কোজিনস্কির ধারণাটা একটু ভিন্ন। তার মতে, পিরামিডের মূল ক্ষেত্রেই লোক লেগেছিল প্রায় ৩ লাখ। আর অফসাইডে প্রয়োজন পড়েছিল আরো ৬০ হাজার মানুষের।পিরামিডের মধ্যে সবচেযে বড় হলো খুফুর।এক সময় প্রায় ৪ হাজার ৪০০ বছর ধরে খুফুর পিরামিড পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থাপত্যকর্ম ছিল। ১৮৮৯ সালে আইফেল টাওয়ার নির্মিত হলে এটি তার গৌরব হারায়।আর এর কক্ষগুলোতে ঢোকার জন্য পেরোতে হতো অনেকগুলো গোলক ধাঁধা। এটি তৈরি করা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫০০০ বছর আগে। এর উচ্চতা প্রায় ৪৮১ ফুট। এটি ৭৫৫ বর্গফুট জমির উপর স্থাপিত। পিরামিডটি তৈরি করা হয় বিশাল বিশাল পাথর খণ্ড দিয়ে পাথর খণ্ডগুলোর একেকটির ওজন ছিল প্রায় ৬০ টন, আর দৈর্ঘ্য ছিল ৩০ থেকে ৪০ ফুটের মতো। এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল দূর-দূরান্তের পাহাড় থেকে। পাথরের সঙ্গে পাথর জোড়া দিয়ে এমনভাবে পিরামিড তৈরি করা হতো যে, একটি পাথর থেকে আরেকটি পাথরের মাঝের অংশে একচুলও ফাঁক থাকত না। পিরামিড তৈরিতে যত পাথর ব্যবহার হয়েছে, ৬ ফুট উঁচু ও ৩ ফুট চওড়া করে পাশাপাশি বসালে সে দেয়াল লম্বায় ৫০ মাইল ছাড়িয়ে যাবে! গড়ে ৯ টনেরও বেশি ওজনের পাথর একটার পর একটা সাজিয়ে বানানো পিরামিড তাই বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের বিস্ময় আর আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু।এখন পর্যন্ত সমগ্র মিসরে প্রায় ১৮০টি পিরামিডের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রায় ৭৫টি এখনো টিকে আছে। কিন্তু কায়রো থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে গিজা এলাকায় অবস্থিত পিরামিডই ভুবনবিখ্যাত। উচ্চতা আর বিশালত্বের কারণে গিজা ও কায়রো ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেলেও চোখে পড়ে তিনটি পিরামিড।মিসরের বিখ্যাত পিরামিডগুলোর একটি স্ফিংস। পূর্ব দিকে মুখ করা এ স্থাপনাটিকে দেখলে মনে হবে এক বিশাল সিংহ মানব সামনে পা ছড়িয়ে বসে রয়েছে। স্ফিংস এর নিচের অংশ দেখতে সিংহের মতো এবং উপরের অংশ বা মাথা তৈরি করা হয়েছে মানব নারীর চেহারা দিয়ে। এটি নির্মাণ করতে চুনাপাথর ব্যবহার করা হয়েছে। স্ফিংস ৫৭ মিটার (১৮৫ ফুট) লম্বা এবং প্রশস্ত ৬ মিটার (২০ ফুট)। এর উচ্চতা ২০ মিটার (৬৫ ফুট)। দুই পা ছড়িয়ে নখর বিশিষ্ট থাবা মেলে রাখা এ সিংহ মানবীর মূর্তিটির গভীর অভ্যন্তরে রয়েছে মন্দির। পিরামিড ও তার নির্মাণশৈলী নিয়ে যুগ যুগ ধরে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। পিরামিডের ভিতরের দেয়ালে আঁকা নানা রকমের ছবি, চিত্রলিপিতে লেখা ধর্মসংগীত আর দেয়ালে খোদাই করা প্রাচীন লিপি উদ্ধার করে এ সম্পর্কে সঠিক খবর জানার চেষ্টা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এরপরও নিশ্চিত হওয়া যায়নি- ঠিক কী কৌশলে তখনকার দিনে সুউচ্চ পিরামিডগুলো তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। এ নিয়ে অনেকগুলো ধারণার প্রচলন রয়েছে। কারো কারো মতে, নির্মাণাধীন পিরামিডের এক পাশ থেকে মাটি বা পাথরের ঢাল তৈরি করে তার ওপর দিয়ে ভারী পাথর টেনে টেনে তুলে পিরামিড বানানো হয়েছে। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞই এ মত প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের মত-পিরামিড যত উঁচু হবে, ঢাল তত প্রশস্ত করতে হবে। এভাবে পিরামিডের চূড়া পর্যন্ত পৌঁছতে ১৩ মাইল লম্বা ঢাল বানাতে হবে, যা অসম্ভব। আবার আরেক মতানুসারে, পিরামিড বানানো হয়েছে ধাপে ধাপে চারপাশ দিয়ে ছোট ছোট ঢাল বানিয়ে। অপর একটি মতে, পিরামিডের চারপাশ মাটি দিয়ে ভরাট করে নির্মাণ কাজ শেষ করা হয়েছে। পরে মাটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বলা বাহুল্য সবকিছুই ধারণা মাত্র। এর প্রকৃত রহস্য অজানা।

মমি রহস্য‬
পিরামিড তৈরির আগে থেকেই মমি তৈরি শিখেছিল মিসরীয়রা। ফারাও রাজবংশের রাজাদের মমি সমাধিস্থ করা হতো পিরামিডের ভিতর। মৃতদেহ দীর্ঘদিন সংরক্ষণে রাখার জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে মমি বানানো হতো। এ কাজে তারা বেশ কিছু রাসায়নিক পদার্থও ব্যবহার করত। আধুনিক বিজ্ঞানীরা এখনো এ রহস্যের কোনো কূলকিনারা করতে পারেননি। তবে কিছু বিষয় ঠিকই অনুমান করা গেছে। বিশ্বজুড়ে মিসরীয় মমি বিখ্যাত হলেও চীন, দক্ষিণ আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মমি খুঁজে পাওয়া গেছে। মারা যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে লাশ রাখলে তাতে ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য জীবাণু আক্রমণ করে। নরম চামড়া নষ্ট করে দেয়। কোনো মরদেহকে মমি করার জন্য সবার আগে সেটিকে ব্যাকটেরিয়ামুক্ত রাখা প্রয়োজন। সাধারণত পানির উপস্থিতিতেই ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়। সে কারণে মমি করার জন্য মরদেহকে দ্রুত পানিমুক্ত করা হতো যাতে সেখানে ব্যাকটেরিয়া ভিড়তে না পারে। সেটা শুকিয়ে নাকি কেমিক্যাল ব্যবহার করা হতো এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, প্রাচীন মিসরীয়রা মরদেহে এক ধরনের কেমিক্যাল দিয়ে সেটি রোদে শুকাত। এছাড়া ধোঁয়ার মাধ্যমেও পানি শুকিয়ে নিত। এ কাজে তারা বিশেষ ধরনের সুগন্ধিও ব্যবহার করত। মিসরীয়দের বিশ্বাস ছিল, তারা মারা যাওয়ার পর যদি তাদের লাশ মমিতে পরিণত করা হয়, তাহলে পরবর্তী জীবনে শান্তি হবে। আর সেজন্য নিজেকে মমিতে রূপান্তরের ব্যাপারে আগ্রহী হয়েই তারা ক্ষান্ত হতো না, বরং চাইত মৃত্যুর পরও ধন-সম্পদের মাঝে ডুবে থাকার মতো নিরাপদ আশ্রয়। এসব কারণেই মমি প্রক্রিয়াকরণ ছিল ব্যয়বহুল। এরকম সাধ্য-সামর্থ্যও সবার ছিল না। তাই ফারাও রাজা, রানী ও তাদের উচ্চপদস্থ দাপ্তরিক কর্মকর্তাদের মমি প্রক্রিয়া এবং সমাধিস্থ করা হতো জাঁকজমকভাবে।

প্রকৃয়া‬
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সুগন্ধি কেমিক্যাল দিয়ে একটি দেহ মমি করতে প্রায় ৭০-৮০ দিন লেগে যেত। প্রক্রিয়াটি বেশ কিছু ধাপে সম্পন্ন করা হতো। প্রথমে মরদেহকে ভালোভাবে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করা হতো। দ্বিতীয় ধাপে দেহের বাম দিকে লম্বালম্বিভাবে চেরা হতো। সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নাড়ি-ভুঁড়িগুলো বের করে ফেলে দেওয়া হতো। থাকত শুধু চামড়া আর হাড়গোড়। নাকের ভিতর দিয়ে হুক ঢুকিয়ে মাথার মগজ বের করে ফেলা হতো। এরপর সেটি যত্নসহকারে ব্যাকটেরিয়ারোধক স্থানে শুকানো হতো।

টাইটানিক ধ্বংসে পিরামিড দায়ী‬
টাইটানিক জাহাজে নাকি ছিল মিসরীয় এক রাজকুমরীর অভিশপ্ত মমি। বলা হয় মমির অভিশাপের কারণেই ভাসমান বরফদ্বীপের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছিল টাইটানিক।
খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে মারা যান ‘প্রিন্সেস অভ আমেন-রা’। নীলনদের পাশে ল্যুক্সরে তাঁর সৎকার করা হয়। উনিশ শতকের নব্বই শতকের শেষ দিকে চার জন ইংরেজকে ওই রাজকুমারীর মৃতদেহসহ একটি মমি কেনার জন্য আহ্বান জানানো হয়। উৎসাহী ইংরেজদের একজন বেশ কয়েক হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে বিক্রেতার কাছ থেকে মমিটি কেনেন এবং সেটিকে নিয়ে আসেন তাদের হোটেলে। কয়েক ঘন্টা পর মরুভূমির দিকে হেঁটে যেতে দেখা যায় ওই ক্রেতা ব্যক্তিকে। তিনি আর কখনও ফিরে আসেন নি।পরেরদিন আরেকজন ইংরেজ এক মিশরীয় ভৃত্য কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হন। এমন ভাবে আহত হন যে তার একটি হাত কেটে ফেলতে হয়তৃতীয় ব্যক্তি দেশে ফিরে আসেন, কিন্তু দেখেন যে, ব্যাংকে গচ্ছিত সমস্ত অর্থ লোপাট হয়ে গেছে অন্য কারও জালিয়াতির মাধ্যমে।চতুর্থ ব্যাক্তি পড়েন প্রচন্ড অসুখে। চাকুরী চলে যায় তার। শেষমেশ তিনি রাস্তায় দিয়াশলাই বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
এদিকে অনেক ঝামেলার পর মমিটি পৌঁছে যায় ইংল্যান্ডে।কিন্তু তবু অভিশপ্ত অধ্যায়ের শেষ হয়নি। ওই কফিনের সাথে সর্ম্পকযুক্ত যে কোন মানুষের ভাগ্যে জুটেছিল দূর্ঘটনা বা মৃত্যু। এমনকী ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষিত মমিটির একজন দর্শনার্থীর ভাগ্যেও জুটে চরম দুর্দশা। ওই দর্শনার্থী মহিলা চরম তাচ্ছিল্যভরে একটি ময়লা পরিষ্কার করার কাপড় দিয়ে মুছেছিলেন কফিনে অঙ্কিত রাজকুমারীর মুখচ্ছবি। কয়েকদিন পর তার সন্তান মারা যায় হাম রোগে।মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ মমিটিকে বেসমেন্টে সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নেয়। এক সপ্তাহের মাঝেই মমি সরানোর কাজে অংশগ্রহনকারী একজন প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওই কাজের তত্বাবধায়ককে তার অফিসের ডেস্কের উপর মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। স্বভাবতই ব্যাপারটি সংবাদপত্রের নজরে আসে। একজন ফটো সাংবাদিক ছবি তুলে ডেভেলপ করে দেখতে পান যে, রাজকুমারীর মুখের বদলে এক বীভৎস চেহারা। জানা যায় যে ওই সাংবাদিক গুলিতে আত্মহত্যা করেন।প্রায় দশ বছর ধরে ঘটতে থাকে এইসব ঘটনা-উপঘটনা। চূড়ান্তভাবে মমিটিকে বিক্রি করা হয় একজন সৌখিন সংগ্রাহকের কাছে। বিচিত্র রকমের দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির পর মমিটিকে তিনি নির্বাসন দেন নিজ বাড়ীর চিলেকোঠায়। অভিশপ্ত ঘটনার পরও একজন মার্কিন প্রত্নতত্ববিদ কিনে নেন মিশরীয় রাজকুমারীর মমি। নিউইর্য়কগামী একটি জাহাজে বুক করেন ওই মমিটি, নিজেও ওঠেন ওই জাহাজে।জাহাজটির নাম টাইটেনিক।এই জন্য টাইটানিক এমন অভিশাপের শিকার বলে অনেকের ধা্রণা।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান

স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট‬