ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান

ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান‬
ভালোবাসার প্রতি প্রতিটি মানুষ কতোটাই কাতর তা মানুষ নাহলে কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।আজ কাল হলিউড,বলিউডের এনিমেশন ফ্লিম গুলোর প্রতি নজর দিলেই দেখতে পাবেন যে, মানুষের স্পর্শে থেকে বনের জন্তু-জানোওয়ার,স্টিল-রডের রোবটও কি সুন্দর প্রেমে মজে যায়।গত বছর ভারতের আলোচিত ফ্লিম পিকে যারা দেখেছেন তারাও তা অনুধাবন করেছেন নিশ্চয়।ভিন গ্রহের প্রেমহীন প্রাণী পিকে (আমির খান) চলে যাওয়ার সময় কাক চড়ই এর আওয়াজ বলে জগৎজান্নির (আনুষ্কা) ভয়েসকে দুই বাকশো কেসেট ফিতায় সংরক্ষণ করে নিয়ে যায় ভালোবেসে।মনুয়ের ভালোবাসা এমনি আকর্ষনীয়।সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল এখনো সগৌরবে দাঁড়ি থাকলেও ব্যাবিলন নেই পৃথিবীর মাঝে।তবুও এটি সপ্তাশ্চার্যের একটি।আজ সেই প্রেমের নগরী নিয়ে সাজানো হলো ৩৩ তম পর্ব।
‪‎নেবুচাদনেজার‬
খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০অব্দের দিকে সুমেরীয় সভ্যতার পতন হলে ব্যাবিলন সে অঞ্চলের শক্তিশালী একটি সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। ব্যাবিলনের প্রথম সম্রাট ছিলেন সারগন।তারপর কয়েকশ বছর ব্যাবিলনের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর হাতে। হিট্টাইট, অ্যাসিরিয়ান, ক্যাসাইট এবং ক্যালডিয়ান জাতি প্রায় হাজার বছর ব্যাবিলনের ক্ষমতা হরণ করে।এরপর ৬২৫ খ্রিষ্টপূর্বে নানোপোলাসার-এর নেতৃত্বে ব্যাবিলন আবার জেগে ওঠে। তিনি অ্যাসারিয়ানদের রাজধানী নিনেভে দখল করে নেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে নেবুচাদনেজার ক্ষমতায় আসেন। তিনি ব্যাবিলকে আরো সমৃদ্ধ এবং জাঁকজমকপূর্ণ করে গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন স্থাপত্য ও শিল্পের প্রতি বিশেষভাবে অনুরাগী। তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির, প্রাসাদ ও স্থাপত্য পূনর্নির্মাণ করেন। ব্যাবিলন শহরকে গড়ে তোলেন সরম্য ও আকর্ষণীয় করে।

কার তরে এতো ভালোবাসা‬
নেবুচাদনেজারের (৬০৫ - ৫৬২ খ্রিষ্টপূর্ব) সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপন হলো ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান বা ঝুলন্ত উদ্যান । এই ঝুলন্ত বাগান গড়ে তোলার পিছনে রহস্য হচ্ছে ভালোবাসার এক অমর গল্প।নেবুচাদের প্রিয়তমা স্ত্রী
অ্যামিতিস। ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান বিশ্বের সপ্তাশ্চার্যের একটি হয়ে ব্যাবিলনের সুখ্যাতি প্রকাশ করছে। সম্রাট নেবুচাদনেজার ছিলেন ভীষণ আমুদে। নিনেভে দখল করার সময় মিডিয়ান সম্রাট তাকে সহযোগিতা করেছিলেন। মিডিয়ান রাজকন্যার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে তিনি তাঁকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর রাজকন্যা হলেন ব্যাবিলনের সম্রাজ্ঞী। কিন্তু ব্যাবিলনের সম্রাজ্ঞীর আদৌ ভালো লাগত না, কারণ মিডিয়া ছিলো পাহাড় পর্বতের দেশ। আর ব্যাবিলন ছিল রুক্ষ সমতল মরুভুমি। সম্রাজ্ঞী পাহাড়ী সবুজ দৃশ্যের,শান্ত শীতল ঝর্না প্রবাহের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। সম্রাট সম্রাজ্ঞীর মনের কথা বুঝতে পেরে তাঁকে খুশী করতে প্রাসাদের ওপর বিশাল পাহাড় তৈরি করেন। পাহাড়ের সঙ্গে তৈরি হলো মনোরম বাগান। সারা পৃথিবী থেকে চমৎকার সব উদ্ভিদ আর ফুল এনে সাজিয়ে দেয়া হল বিশ্ববিখ্যাত এই বাগান। কারণ তিনি চেয়েছিলেন পৃথিবীর সব আনন্দ আর সুখের সম্রাজ্ঞীর জন্য ভালোবাসার প্রতীক অঙ্কন করতে।

রহস্যের ব্যাবিলন‬
বর্তমান ইরাকের প্রাচীন এক নগরীর নাম ব্যাবলন।Hanging Gardens of Babylonইরাকের ইউফ্রেটিস বা ফোরাত নদীর তীরে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে নির্মিত হয়।এই উদ্যান তৈরির প্রথমে নির্মাণ করা হয় বিশাল এক ভিত, যার আয়তন ছিল ৮০০ বর্গফুট। ভিতটিকে স্থাপন করা হয় সম্রাটের উপাসনালয়ের ছাদে। ভিত্তি স্থাপন করার পর মাটি থেকে এর উচ্চতা দাড়িয়েছিল ৮০ ফুট।এই ভিত্তির উপরেই নির্মিত হয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং বিস্ময়কর ফুলের বাগান। ৪০০০ শ্রমিক রাতদিন পরিশ্রম করে তৈরি করেছিল এই বাগান। বাগান পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত ছিল ১০৫০ জন মালী। ৫ থেকে ৬ হাজার প্রকার ফুলের চারা রোপণ করা হয়েছিল এই ঝুলন্ত বাগানে। ৮০ ফুট উচুতে অবস্থিত বাগানের সুউচ্চ ধাপগুলোতে নদী থেকে পানি উঠানো হত মোটা পেচানো নলের সাহায্যে।যদিও এটি ছিলো অত্যন্ত ব্যয় সাপেক্ষ।ভালোবাসার জন্য মানুষ কত কিছু তো করে।এই উদ্যান নিযে রয়েছে ইতিহাসবেত্তাদের মধ্যে নানান বিতর্ক।ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান সম্পর্কে কিছুটা আশা দেখান জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক রবার্ট কোল্ডওয়ে।১৮৯৯ সালে তিনি ব্যাবিল শহরে খনন কাজ শুরু করেন। রাজা নেবুচাদনেজার এর প্রাসাদ,দুর্গ,টাওয়ার অব ব্যাবিল এবং নগর রক্ষাকারী দেওয়াল সবই পাওয়া যায় তার খনন কাজে। শেষদিকে তিনি ১৪টি রুমবিশিষ্ট একটি স্থান খুঁজে পান যার ছাদ ছিল পাথরের তৈরি। ব্যাবিলনের প্রাচীন ইতিহাস অনুযায়ী উত্তর দিকের দুর্গ এবং ঝুলন্ত বাগান ছাড়া আর কোথাও ছাদ তৈরিতে পাথর ব্যবহারের কথা উল্লেখ ছিল না। এবং ঐ দুর্গ তিনি আগেই খুঁজে পাওয়ায় এই স্থানটিই ঝুলন্ত বাগান ছিল তা দাবী করেন তিনি। এমনকি তিনি চেইন পাম্প ব্যবহার করা হত এমন একটি কক্ষও খুঁজে পান। যা বাগানটির অস্তিত্ব স্বপক্ষে জোরালো প্রমাণ দেয়।
ব্যাবিলনের পতন‬
বর্তমান ইরাক ইরানের দ্বন্দ্ব সেই প্রাচীন যুগ ধরে চলে আসা একটি রাজনৈতিক রেশারেশির ফল।ভারত পাকিস্তানের বৈরিভাবের ইতিহাস সুদীর্ঘ নয়।যা আমরা চেষ্টা করলে হাতে গোনেতে পারি।কিন্তু ইরাক ইরানের সহ মধ্যএশিয়ার দ্বন্দ্ব সেই অব্দ থেকে।পারস্য (ইরান) সম্রাট সাইরাস ৫১৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জেরুজালেম দখল করে শহরটি ধ্বংস করেন। তাদের উপসনালয় এবং রাজপ্রাসাদ পুড়িয়ে দেন। তার সময় থেকেই ব্যাবিলনের সাম্রাজ্য ম্লান হতে থাকে। তার পরবর্তীকালে নেবোনিডাস সম্রাট হন। তবে ব্যাবিলনের সমৃদ্ধি হারিয়ে যেতে থাকে। ব্যাবিলন এখন ধ্বংস স্তুপ। পারসিয়ান সম্রাটের প্রচন্ড আক্রমণে নিমিষেই ধুলোয় মিশে গিয়েছিলো প্রেমের নগরী ব্যাবিলন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট‬